মুজিব যেভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন
কৈশোরেই শেখ মুজিবুরের হাতেখড়ি হয়েছিল রাজনীতির। নানা আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত রেখে আপন যোগ্যতায় ওই সময়ে হয়ে ওঠেন ছাত্রদের নেতা। গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে একদিন তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। সেই মহামানবের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী এদিন পুরো জাতি পালন করছে যথাযোগ্য মর্যাদায়।
ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন পাকিস্তান আন্দোলনে। নতুন দেশ সৃষ্টির পর তিনি দেখতে পান নির্যাতন আর শোষণের শিকার হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ।
দেশভাগের পরপরই বাংলার ওপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এর জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৪৮ সালে গ্রেফতারও হন তিনি। ১৯৪৯ সালে তিনি নির্বাচিত হন তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম সম্পাদক। কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তির সনদ ছয় দফা ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
মুক্তিযুদ্ধের আগের কয়েকটি বছর ছিল জাতির ক্রান্তিকাল। পাকিস্তানি শাসকদের হাতে নানা ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছিল। তখনই ১৯৬৬ সালে লাহোরে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন শেখ মুজিব। বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শেখ মুজিবসহ ৩৫ জনকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন শুরু হয় এ মামলার বিচারকাজ।
মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পরই ফুঁসে ওঠে বাংলার মানুষ। তৎকালীন শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে নামে ছাত্র-জনতা, উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কার্যালয়ে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে সান্ধ্য আইন জারি করে সামরিক সরকার। কিন্তু এ সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল করে ছাত্রসমাজ।
১৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকেও হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের পর আইয়ুব খান আবার সান্ধ্য আইন জারি করেন। এর প্রতিবাদে ২০ ফেব্রুয়ারি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। আইয়ুব খান তখন সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করে নেন।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনে শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেফতার করা সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। আর ওই আলটিমেটামে বাধ্য হয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দিকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে করতে বাধ্য হন আইয়ুব খান।
যেভাবে হলেন বঙ্গবন্ধু
দেশের মানুষকে শাসকদের গোলামি থেকে মুক্ত করতে ও স্বাধীনতার চেতনা জাগাতে শেখ মুজিব হেঁটে বেড়িয়েছেন বাংলার পথে-প্রান্তরে। দেখেছেন মানুষের কষ্ট, শুনেছেন যাতনার গল্প। একই সঙ্গে তাদের দেখিয়েছেন মুক্তির স্বপ্ন, করেছেন ঐক্যবদ্ধ।
এর মধ্যদিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন মুজিব ভাই। এ নামটি বেশ জনপ্রিয়তা পায় সবার কাছে। এছাড়া ‘শেখের বেটা’, ‘বাংলার মুজিব’, ‘শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গশার্দূল’ নামেও মানুষ তাকে ডাকতো। তবে সব ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠস্বর; হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি তিনি এমনি এমনি পাননি। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানুষের অধিকার আদায় করেছেন। কারাগারে বসে দিন কাটিয়েছেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগার থেকে নিঃশর্ত মুক্তির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) গণসংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে তৎকালীন ডাকসু ভিপি, বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকে বাংলার জনগণের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে।
তোফায়েল আহমেদ তার এক লেখায় বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে সেদিন আমি ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, ‘প্রিয় নেতা তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। এ ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। সারা জীবন এ ঋণের বোঝা আমাদের বয়ে চলতে হবে। আজ এ ঋণের বোঝাটাকে একটু হালকা করতে চাই জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে একটা উপাধি দিয়ে। এরপরই বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। লাখ লাখ লোক তুমুল করতালির মধ্যদিয়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে ধ্বনি তুলেছিলেন, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।’’
স্বাধীনতার পথে বাঙালি জাতি যে কয়েকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে, প্রতিটিতে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তী সময়ে ১১ দফা আন্দোলন ছিল তার নেতৃত্বের ফসল।
মুক্তির বাণী ৭ মার্চের ভাষণ
বঙ্গবন্ধু উপাধি পেয়ে থেমে থাকেননি শেখ মুজিবুর রহমান। বরং এ বিষয়টি যেন তার কাজে আরও গতি এনেছিল। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিতে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে আরও বেশি করে যুক্ত করতে থাকেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরের ৭ মার্চ বজ্রকণ্ঠে বাঙালি জাতির মুক্তির কথা শোনান তিনি। ওইদিন দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের মূল স্বাধীনতা সংগ্রাম।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক অনন্য দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ দিনে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।
লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা দেন: ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্রে রূপ নেয়। এ ভাষণ শুধু রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ও। পরে এ ভাষণটিকেই বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। এছাড়া ভাষণটি পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেদিন ১৯ মিনিটের অলিখিত এক ভাষণ দিয়েছিলেন, যে ভাষণ দেশসহ বিশ্বকে নাড়িয়ে তুলেছিল। এটি পরবর্তী সময়ে বিশ্বদরবারেও স্থান করে নিয়েছে।’
১৯৪৭ সালে ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের ভিত রচিত হয়। তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এ বিজয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।