কিছু না বলেও সেদিন কত কথা বলে গেছেন বঙ্গবন্ধু
বিরতি দিয়ে আবারও বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের পক্ষে ইয়াহিয়া খান। সেদিনের বৈঠকটি যে অকার্যকর ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বৈঠক থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যা কিছু বলেছেন—তার বাইরে অনেক কথা ছিল, যা তিনি বলেননি। কেবল মুচকি হেসেছিলেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে। অনেক কথা বলেও সেই না বলা কথাগুলোর শক্তি ছিল অসামান্য।
বঙ্গবন্ধু জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের প্রশ্নে অটল থাকেন। অপরদিকে ইয়াহিয়া খান জনগণের ভোটে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বৈঠকে শুরু হয় অচলাবস্থা। একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা ভেঙে যায়। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হয়ে আসে। আগের মতোই তাঁর সাদা গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা এবং অপর পাশে শোভা পাচ্ছিল বাংলাদেশের প্রস্তাবিত মানচিত্র খচিত পতাকা।
আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আলোচনা শেষ হয়ে যায়নি। তবে পরবর্তী বৈঠকের তারিখ এখনও ঠিক হয়নি। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’ সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজের বাসভবনে ফিরে এলে একজন সাংবাদিক জানতে চান—‘বৈঠক সংক্ষিপ্ত হলো কেন?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু মৃদু হাসেন। আরেক বিদেশি সাংবাদিক বলেন, ‘এই হাসি থেকে আমরা কি কিছু অনুমান করে নিতে পারি?’ জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনার মুখেও তো মৃদু হাসি। আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি।’ ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বঙ্গবন্ধু সন্তুষ্ট কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো বলেছি, নরকে বসেও আমার চিত্তে সুখের অভাব হবে না। আমার চেয়ে বেশি সুখী আর কে আছে? সাত কোটি মানুষ আজ আমার পেছনে পাহাড়ের মতো অটল। আমার জনগণ যা দিয়েছে তার তুলনা নেই।’
জন্মদিন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা
এই দিনেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানের। জন্মদিনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমার জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনও মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে।’
সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। আমার ৮৯ বছরের অতীতের সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সর্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো একতা ও সহযোগিতা আমি এর আগে কখনও দেখিনি।’
অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিবসে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন। লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকরা পৃথক বিবৃতিতে ভুট্টোর ‘দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব’ প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন গোটা দেশের জন্য হয়েছে। দুই অংশের জন্য পৃথক নির্বাচন হয়নি। কাজেই জাতীয় পরিষদে একটি মাত্র মেজরিটি পার্টি থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চূড়ান্ত
পরবর্তী সাক্ষী-সাবুদের ভিত্তিতে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, একাত্তরের আজকের দিনেই টিক্কা খান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত নৃশংস কার্যকলাপের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিলে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত তদন্ত কমিশন মানি না।’ এদিন গভীর রাতে ঢাকায় পাকিস্তান জেনারেলদের গোপন বৈঠক বসে। মূলত ইয়াহিয়া খানের ‘আলোচনা নাটকের’ আড়ালেই চলতে থাকে ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা। এ রাতেই প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে টিক্কা খানের বৈঠক হয়। গভীর রাতেই জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ঢাকায় সামরিক জান্তার বৈঠকে বাঙালি হত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চূড়ান্ত করা হয় এদিনই।